ঢাকার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা গত কয়েকবছরে হুড়হুড়িয়ে বেড়েছে৷ আমার গৃহিনী মাও একদিন আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘শুনেছিস, তোর অমুক আত্মীয় শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে বেশ লাভ করেছে’৷ আমি বলি, ‘ভালো কথা, তবে তাঁর সতর্ক হওয়া উচিত৷ কারণ শেয়ারবাজার বড়ই নড়বড়ে’৷
ঢাকার শেয়ারবাজার একটি বড় ক্ষেত্র৷ সেখানে অর্থলগ্নির পরিমাণও বেশ বড়৷ গত কয়েকবছরে শেয়ারবাজারে একাধিকবার বড় ধরনের দরপতন হয়েছে৷ অনেকে সর্বশান্ত হয়েছেন৷ সবাই জানে, নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি শেয়ার বাজার নিয়ে খেলছে৷ সুযোগবুঝে বাজার থেকে সব পয়সা তুলে নিচ্ছে৷ সরকার তাদের খেলা থামাতে ব্যর্থ৷ তবুও কী শেয়ার বাজারে সাধারনের বিনিয়োগ বন্ধ হচ্ছে?
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বন্ধ না হওয়ার পেছনে একটা ইতিবাচক চিন্তা কাজ করে৷ অর্থ খোয়ানো মানুষগুলোর মধ্যে সম্ভবত আশা জাগছে, পরেরবার নিশ্চয়ই লাভ করা যাবে৷ দেখিনা আরেকবার চেষ্টা করে৷ শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে বড়, মুনাফাও বেশি৷ ইতিবাচক চিন্তাও বেশি৷
নাজমুল নয়ন নামের একজন বাংলা ব্লগারের একটি কথা আমার খুব পছন্দ হয়েছে, ‘‘আমারা চিন্তা করি বেশি কথা বলি বেশী কাজ করি কম, সামনে দিয়া শত শত হাতি গেলেও ভয়ে থামাই না, পেছন দিয়ে মশা গেলেই কাম সারছে…”৷
এখানে ‘হাতি’কে আমি শেয়ারবাজারের বড় খেলুড়েদের সঙ্গে তুলনা করতে পারি৷ আর ‘মশা’ হচ্ছে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রক্রিয়া৷ এই প্রক্রিয়া নিয়ে কয়েকবছর আগে বাংলাদেশে সম্ভবত প্রথম আলোচনা শুরু করেন পল্লব মোহাইমেন (যতদূর মনে পড়ে, তিনিই প্রথম সাংবাদিক, যিনি এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের সম্ভাব্যতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন)৷
শুরুর দিকে এই প্রক্রিয়ায় সুন্দরবন এবং কক্সবাজার ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছিল৷ অনলাইন ভোট চলছে, জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রযুক্তি পাতা ছাড়িয়ে মূল পাতায় সেই খবর প্রকাশ হতে শুরু করেছে৷ সবমিলিয়ে একটা জমজমাট ভাব৷
কিন্তু চলতি বছরে কিছু মানুষের মনে ‘নেতিবাচক’ চিন্তার উদ্রেক হল৷ দুই টাকা খরচ করে এসএমএস ভোট প্রদানে তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য খুঁজে পেল৷ শুরু হল ‘মশা’ নিধনের প্রক্রিয়া৷ আমাদের স্বজাতির একটি অংশ কামান নিয়ে নেমে পড়ল এই কাজে৷
তাদের নিধন প্রক্রিয়ায় এক বড় সমর্থন ছিল মালদ্বীপ৷ জানা গেল, সেদেশ এই প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছে৷ প্রশ্ন উঠল, মালদ্বীপ যেখানে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরে গেছে, আমরা কেন সেখানে থাকবো? সাদা মনে অনেকেই ভেবেছেন, মালদ্বীপকেই আমাদের অনুসরন করা উচিত৷ কিন্তু কেন অনুসরন করা উচিত বা উচিত নয়, সেটা কী আমরা বিবেচনায় এনেছি?
প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন থেকে আমাদের পর্যটন খাতে বড় লাভ হতে পারত৷ বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকরা আমাদের সুন্দরবন দেখতে বাংলাদেশ ভ্রমণে উৎসাহী হতে পারতেন৷ বাংলাদেশ যে শুধু বন্যা আর পানির দেশ নয়, সেটাও মানুষ জানত৷
পর্যটনের এই দিকটা বিবেচনা করলে মালদ্বীপের অবস্থা কিন্তু পুরোই ভিন্ন৷ বিশ্বের তাবত পর্যটকের কাছে ইতিমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত দেশ মালদ্বীপ৷ ভারত মহাসাগরের এই দেশটিতে পর্যটকের ভিড় লেগে থাকে সবসময়৷ যেকারণে সেদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বাংলাদেশি টাকায় চল্লিশ হাজার টাকা!
এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কী, বছরে কতজন বিদেশি পর্যটক সুন্দরবন দেখতে আসেন? আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আর সমুদ্রতট অবস্থিত, কতজন মানুষ সেটা জানেন? পর্যটন খাত থেকে আমাদের আয়ই বা কেমন? মালদ্বীপের সঙ্গে এসবের তুলনা কী আমাদের চলে?
পাঠক আপনি নিজেই ভাবুন এসব প্রশ্নের উত্তর৷ আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাই বলার আছে, মালদ্বীপের পর্যটন খাতের সঙ্গে আমাদের তুলনা চলে না৷ এক্ষেত্রে সেদেশ আমাদের চেয়ে অনেক উপরে উঠে গেছে৷ তাই, তাদের হয়ত নতুন করে সপ্তাশ্চর্যে নাম লেখানোর প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমাদের আছে৷ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যদি গড়ে দুই বা দশটাকা খরচ করে সেই প্রয়োজন মেটাতো, তাতে লাভ আমাদেরই হত৷ কিন্তু প্রতিযোগিতার একপর্যায়ে এসে আমরা ‘মশা’ নিধনে আগ্রহী হলাম, ভোট হারাতে শুরু করল সুন্দরবন৷
এই প্রতিযোগিতার আয়োজক সংস্থা নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্সের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমাদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল৷ দৈনিক প্রথম আলোয় আনিসুল হক সেটার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ আমার কাছে সেই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে৷ একটি বিষয় এখানে আমাদের বিবেচনা করা উচিত৷ প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচনা হয়েছে, আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও আর্জেন্টিনা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশ এই সুযোগ লুফে নিয়েছে৷ এখানে আমাদের দেশের একটা পরোক্ষ ব্র্যান্ডিং হয়েছে৷ এসব দেশের ভোটাররা, পর্যটকরা ঘুরে ফিরে সুন্দরবনের নাম শুনেছেন, সুন্দরবনের বদৌলতে বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনেছেন৷ আমরা হেরে গেলেও এই লাভটুকু হয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু জিতে গেলে সেটা আরও অনেক দূরে প্রসারিত হত৷ যখন এই প্রতিবেদনটি লিখছি, তখন গুগল নিউজে এই বিষয়ে কয়েক হাজার প্রতিবেদন শোভা পাচ্ছে, সেখানে ঘুরেফিরে আসছে আমাজন (দক্ষিণ আমেরিকা), হ্যালং বে (ভিয়েতনাম), ইগুয়াজু জলপ্রপাত (আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল), জেজু দ্বীপ (দক্ষিণ কোরিয়া), কোমোডো জাতীয় উদ্যান (ইন্দোনেশিয়া), পুয়ের্তো প্রিন্সেসা আন্ডারগ্রাউন্ড রিভার (ফিলিপাইনস), টেবিল মাউন্টেন (দক্ষিণ আফ্রিকা) এর নাম৷ নেই সুন্দরবন (বাংলাদেশ, ভারত) নামটি৷
২০০৪ সালে ভিয়েতনামের হ্যালং বে ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল আমার৷ এককথায় বলব আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ভ্রমণ সেটি৷ সত্যিই হ্যালং বে এই তালিকায় আসার সকল যোগ্যতা রাখে৷ অন্যান্য স্থানগুলোর ছবি দেখেও সন্তুষ্ট আমি৷ বিতর্কিত বা কারো মতে আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য একটি সংগঠনের নির্বাচিত সাত সৌন্দর্য নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ নেই৷
বাঙালি হিসেবে আমরা ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখি৷ এতে অপরাধের কিছু নেই৷ কিন্তু জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাও বড় জরুরি৷ ব্যক্তিস্বার্থে ‘হাতি’র ধ্বংসযজ্ঞ থামানো যেমন প্রয়োজন, তেমনি জাতীয় স্বার্থে ‘মশা’কে সমর্থনের ইতিবাচক মনোভাবও দরকার৷ নতুবা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই হবে না৷ বায়ান্ন, একাত্তরের সেই ঐক্যবদ্ধ জাতি কী আমরা আর কখনোই পাবোনা?
Source: n-rb.com/2011/11/12/বাঙালি-সুন্দরবন/
No comments:
Post a Comment