এম এস শহিদ : পাহাড়ের গায়ের ফাটলকে গিরিখাত বলা হয়। তবে এ ফাটল ছোটখাটো নয়, বিশাল বিশাল ফাটল। এতোই বিশাল যে, কিছু কিছু জায়গায় এসব ফাটল এক মাইল পর্যন্ত চওড়া হয়ে থাকে। তবে এসব ফাটল কিন্তু একদিনে সৃষ্টি হয়নি। কোটি কোটি বৎসর ধরে ধীরে ধীরে তৈরি হয় এসব ফাটল। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত এমনই একটি অদ্ভূত গিরিখাতের না দ্য গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এটি প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ বছরের পুরনো। গ্র্যান্ড ক্যারিয়ন লম্বায় প্রায় ৪৪৬ কিলোমিটার এবং কিছু কিছু জায়গায় এ গিরিখাত প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, এ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা প্রায় ৬০০০ ফুট বা ১৮০০ মিটার। বিশাল এ গিরিখাতের মধ্যদিয়ে কলোরাডো নামে একটি নদী বয়ে গেছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বেশিরভাগই ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক' এর মধ্যে পড়েছে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেন্ট এ গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। পৃথিবীর ভৌগলিক পরিবর্তনের কারণেই এ সুবিশাল গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি হয়েছে। তবে একদিনে কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি হয়নি। এর বর্তমান অবস্থায় আসতে বহু বছর লেগে গেছে। তবে কতো বছর আগে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি হতে শুরু করেছিলো সে সম্পর্কে কিন্তু ভূতত্ত্ববিদরা এখনো একমত হতে পারেননি। তবে কিছু কিছু তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ১৭ মিলিয়ন বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিলো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।
শুরুতে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেহারাও বর্তমানের মতো ছিল না এবং সেসময় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মধ্যে দিয়ে কলোরাডো নদী প্রবাহিত হতো। আর তখন এ নদীর অকেগুলো শাখা প্রশাখাও ছিলো। ধীরে ধীরে এসব নদীর তীরে পলি জমল। সেই পলিমাটি ক্রমে ক্রমে কঠিন হয়ে পরিণত হলো পাথরে। আর এসব পাথরই এক সময় নদীর গতিপথ পাল্টে দিলো। আবার এসব পাথর নদীর স্রোতেই ক্ষয় হয়ে নতুন নদীপথ তৈরি হচ্ছে। পৃথিবীর গিরিখাতগুলোর মধ্যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সবচেয়ে বিখ্যাত। তবে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গিরিখাত কিংবা গভীর গিরিখাতও নয়। নেপালের ‘কালি গন্দকি জর্জ' নামক গিরিখাতটি আরো গভীর। আর অস্ট্রেলিয়ার ‘ক্যাপারটি ভ্যালি' গিরিখাতটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়েও প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা ও চওড়া। তবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন গিরিখাতটি বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এর বিশালত্ব, নান্দনিক দৃশ্য, দুর্গম অঞ্চল আর বিচিত্র রংয়ের পাথরে গড়া পাহাড়ের সমাবেশেই ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে কাছে টেনে নেয়। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বড় বড় পাথরগুলো সুন্দরভাবে সাজানো, যা দেখলে যে কেউই মুগ্ধ হতে বাধ্য। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পাথরগুলো স্তরে স্তরে সজ্জিত। একেকটা স্তরকে বলা হয় প্লেট। কলোরাডো নদী থেকে উৎপন্ন বলে এখানকার প্লেটগুলোকে কলোরাডো প্লেট বলা হয়। লাখ লাখ বছর সময় লেগেছে এ প্লেটগুলো তৈরি হতে। বেশিরভাগ ভূতত্ত্ববিদ মনে করেন প্রায় ১৭ মিলিয়ন বছর আগে এসব প্লেট তৈরি হয়। তবে এগুলো আরো আগের বলে অনেকেই মনে করেন। তাদের মতে, পাথরের এসব প্লেট তৈরি হতে প্রায় ৪০ মিলিয়ন বা ৪ কোটি বছর লেগেছিলো। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সবচেয়ে নিচের স্তর সৃষ্টি হয় প্রায় ৬ কোটি বছর আগে। এ স্তর শীর্ষ থেকে প্রায় ৫ থেকে ১০ হাজার ফুট নিচে অবস্থিত। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পাথরের স্তরগুলোর মধ্যে নিচের স্তরটি সবার আগে তৈরি হয়েছিলো। এরপর এ স্তর ধীরে ধীরে খাড়া ওপরে উঠে যেতে থাকে। তৈরি করতে থাকে পাথরের নতুন নতুন স্তর। আবার কলোরাডো ও তার শাখা-প্রশাখাগুলো ছিল ভীষণ খরস্রোতা, এদের স্রোতের কারণে পাথর ক্ষয় হয়ে নদীর নতুন গতিপথ সৃষ্টি হতে লাগলো এবং সেইসাথে ক্ষয়ে যাওয়া সেসব পাথর থেকে নতুন নতুন স্তরও সৃষ্টি হতে লাগলো। এরপর বরফের যুগ। বরফ যুগের পরে বরফ গলে নদীতে পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে স্রোতও বেড়ে গেলো। এ স্রোতের কারণে পাথরের স্তর আরো দ্রুতগতিতে ক্ষয়ে আরো গভীর হয়ে যেতে লাগলো। অতঃপর প্রায় ৫৩ লাখ বছর আগে কলোরাডো নদীর একেবারে নিচের স্তর তৈরি হয়। ভিত্তি তৈরি হয়ে যাওয়ার ফলে কলোরাডোর স্রোত এর চারপাশের পাথরগুলোকে আরো বেশি ক্ষয় করতে থাকে।
এভাবে ক্ষয় হতে হতে এ নদী আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কলোরাডো নদীর চারপাশের দেয়ালে পাথরের যে স্তরগুলো দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোও একরমক ক্ষয় হয়েই সৃষ্টি হয়েছে। আর বর্তামন কলোরাডো নদীর যে গভীরতা সেটিও প্রায় ১২ লাখ বছর আগে হয়েছিলো। এরপর ৩০ থেকে ১ লাখ বছর আগের সময়ের মধ্যে পৃথিবীর আগ্নেয়গিরিগুলোতে ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাত হতো এবং এর ফলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘটলো আরো পরিবর্তন। আগ্নেয়গিরির লাভা আর ছাই এসে জমা হতে লাগলো কলোরাডো নদীর তলদেশে আর এর আশপাশের এলাকায়। বছরের পর বছর এসব ছাই আর লাভা জমা হয়ে সেগুলো ক্রমে ক্রমে জমে রূপান্তরিত হয় পাথরে। এসব লাভা আর ছাই দিয়ে তৈরি হয় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সবচেয়ে নতুন পাথরের স্তরগুলো। সমগ্র গ্রা্যন্ড ক্যানিয়ানকে প্রধানত ২টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। নর্থ রিম এবং সাউথ রিম নামে এ ২টি অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থার মধ্যে বেশ পার্থক্য থাকায় এদের মধ্যকার আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যে বেশ তারতম্য রয়েছে। সাউথ রিমের চেয়ে নর্থ রিমের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কম। কারণ নর্থ রিমের পাহাড়গুলো সাউথ রিমের পাহাড়গুলোর চেয়ে প্রায় ১ হাজার ফুট বেশি উঁচু। আর নর্থ রিমের পাহাড়গুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে প্রায় ৮ হাজার ফুট। কলোরাডো নদীটি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। নদী তার উৎপত্তিস্থল থেকে যতো দূরে যাবে এর স্রোতও ততো হ্রাস পেতে থাকবে। তার মানে দাঁড়াল কলোরাডো নদীর উৎপত্তিস্থল উত্তর দিকে হওয়ায় সেখানে নদীর স্রোতও বেশি। আর স্রোত বেশি হওয়ায় সেখানে নদী আরো বেশি পরিমাণ পাথর ক্ষয় করতে পারে। ফলে আরো বেশি পরিমাণে পলি নদীতে জমে। আর সে কারণেই নর্থ রিমের পাহাড়গুলো সাউথ রিমের পাহাড়গুলোর চেয়ে বেশি উঁচু। তবে গ্রীষ্মকালে ২টি অঞ্চল্পেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যেতে হলে গ্রীষ্মকালে যাওয়াই ভালো। কেননা শীতকালে সেখানে প্রচুর বরফ পড়ার কারণে নর্থ রিমের রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়। আর নর্থ রিমে যেতে না পারলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের আসল সৌন্দর্যটাই উপভোগ করা যাবে না। শুনে অবাক মনে হলেও সত্যি হলো, দুর্গম পাথরের এ গিরিখাতেও মানুষ বাস করে। যেমন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে প্রচন্ড ঠান্ডা আর বরফ থাকা সত্ত্বেও সেখানে এক্সিমোরা বাস করে, তেমন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নেও বাস করে এক বিশেষ জাতি। তাদের নাম হচ্ছে ‘পুয়েব্লো'।
এরাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের আদি অধিবাসী। ইউরোপীয়ানরা আমেরিকায় পৌঁছার অনেক আগে থেকে তারা এ দুর্গম গিরিখাত অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। পুয়েব্লোরাই প্রথম এ অঞ্চলের নাম দেয় অংতুপকা। এটা পুয়েব্লোদের নিজস্ব ভাষার নাম। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পুয়েব্লোদের কাছে পবিত্র জায়গা বা তীর্থস্থান নামে পরিচিত। পুয়েব্লো ছাড়াও এখানে ইয়ুমান, হাভাসপাই, ওয়ালাপাই জাতি বাস করে। এদের সবাইকে প্রাচীন ‘কোহোনিনা' জাতির বংশধর বলে মনে করা হয়। ৫০০ থেকে ১২০০ খৃষ্টাব্দ সময়ের মধ্যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিম অংশে কোহোনিনারা বাস করতো। এছাড়া ৫০০-১৪৫০ খৃষ্টাব্দের মধ্য সময়ে ‘সিনাগুয়া' নামের একটি জাতি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বাস করতো। কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে তারা হারিয়ে গেছে। এদের কোনো বংশধরই আর জীবিত নেই।
No comments:
Post a Comment