Friday, December 31, 2010

পাখিদের উড্ডয়ন: রহস্য ও প্রজ্ঞার V

পাখিদের উড্ডয়ন: রহস্য ও প্রজ্ঞার V

By- ম্যাভেরিক


শীতের হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসা অতিথি রাজহংস কিংবা সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা সরালীর ঝাঁকে যদি কখনো তাকান, দেখতে পাবেন V আকারে এগিয়ে চলছে পাখির দল।


কেন এই V আকারে ভেসে চলা? কারণটি কি এই, পাখিরা E বা G কিংবা অন্য কোনো বর্ণ ফুটিয়ে তুলতে পারে না আকাশে!

অধিকাংশ পাখি-বিশেষজ্ঞ (ornithologist) বিশ্বাস করেন, বিন্যাসটি সুদক্ষ উড্ডয়নের প্রয়োজনে গঠিত হয়, যদিও তারা এ ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি বহুদিন। এই শতাব্দীর একেবারে শুরুতে বিজ্ঞানীদের একটি দল ছোট বিমানের পেছন পেছন উড্ডয়নের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক ঝাঁক পেলিক্যানের উপর গবেষণা করে দেখতে পান, V বিন্যাসে উড়ার সময় পাখির হৃদস্পন্দন, একা একা উড়ার সময়কার হৃদস্পন্দনের চেয়ে কম থাকে। ধীরে ধীরে প্রমাণ মেলে পাখির বায়ুগতিবিদ্যা (aerodynamics) সংক্রান্ত নানা বিস্ময়কর তথ্যের:

উড্ডয়নের জন্য ঝাঁকের একটি পাখি যখন ডানা ঝাপটায়, এর ঠিক পেছনের পাখিটির উপর বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী ঘূর্ণাবর্ত (vortex) সৃষ্টি হয়। ঊর্ধ্বচাপের সুবিধা কাজে লাগিয়ে পেছনের পাখিটি সামনেরটির চেয়ে একটু উপরে অবস্থান করে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে কম শক্তি ব্যয় করেও ভেসে থাকে। এভাবে পাখির ঝাঁকটি একা একা উড্ডয়নে অতিক্রান্ত দূরত্বের চেয়ে ন্যূনতম ৭০ শতাংশ অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে!

যদি কোনো পাখি বিন্যাসের বাইরে চলে যায়, সাথে সাথে এটি বাতাসের অতিরিক্ত টান (drag) ও বাধা অনুভব করে। পরিবর্তনটি বুঝতে পেরে পাখিটি দ্রুত বিন্যাসে চলে আসে এবং সামনের পাখিটির কাছ থেকে সৃষ্ট উড্ডয়ন সুবিধা লাভ করে।


সামনের দলনেতা পাখিটি বাতাসের সবচেয়ে বেশি বাধা অনুভব করে, এবং ক্লান্ত হয়ে গেলে পাখা ঝাপটানোর বেগ কমিয়ে দিয়ে এটি ঝাঁকের পেছন দিকে সরে আসতে থাকে। পেছনের আরেকটি পাখি তখন নেতার স্থানটি গ্রহণ করে।
মজার ব্যাপার হলো, V-এর দুই ডানার সবচেয়ে পেছনের পাখি দুটি আবার মাঝের পাখিগুলির চেয়ে বেশি টান অনুভব করে, ফলে ক্লান্তি লাঘবের জন্য এদেরও নিয়মিত স্থান পরিবর্তিত হতে থাকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব পাখি ঝাঁকের মাঝখানে থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করে এবং অগ্রভাগে নেতা হিসেবে সবচেয়ে বেশি বাধার মুখোমুখি হয়।


V-বিন্যাস পাখিদের যোগাযোগ রক্ষার কাজটি সহজতর করে। এ বিন্যাসে পাখিরা পরস্পরের সাথে খুব চমৎকার ঐক্ষিক যোগযোগ (visual contact) বজায় রাখতে পারে, যা ঝাঁকটি সুসংহত, ঐক্যবদ্ধ রাখে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমার সময় এতে ঝাঁক থেকে পাখি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কমে যায়। এ ছাড়া পেছনের পাখি চিৎকার করে সামনের পাখিকে নিয়মিত উৎসাহ দিয়ে যায়, যাতে সামনের পাখি তার গতিবেগ বজায় রাখে।


কোনো পাখি অসুস্থ, শিকারীর গুলিতে আহত, কিংবা খুব ক্লান্ত হয়ে বিন্যাসের বাইরে চলে গেলে, তার সাথে আরো পাখি নেমে আসে সাহায্য ও নিরাপত্তার জন্য। এরা অসহায় পাখিটির সাথে থেকে যায় যতক্ষণ না সে সুস্থ হয় বা মারা যায়। তারপর তারা উড়ে মূল দলের কাছে পৌঁছে যায়, নতুবা অন্য কোনো দলের সাথে জুড়ে যায়, কিংবা নিজেরাই নতুন বিন্যাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।

____________________



কত অপার রহস্য ছড়িয়ে রেখেছেন স্রষ্টা! চারপাশে বিরাজমান সহমর্মিতার কত না নিদর্শন! পাখির কাছে বিজ্ঞান ও মানবতার কী গভীর প্রজ্ঞা!

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০০৯ রাত ৮:০১

Thursday, December 30, 2010

চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি

চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি এস এম রানা, চট্টগ্রাম, ১২ ডিসেম্বর ২০১০ চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে হাতি চলাচলের পথ (করিডর) ১০টি। এর মধ্যে তিনটিতেই এখন হাতির বিচরণ নেই। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) মাধ্যমে পরিচালিত সমীক্ষায় এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বন্য প্রাণী নিয়ে কাজ করা দি ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) গত নভেম্বরে এ সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়, ফাঁদ পেতে হত্যা, দুর্ঘটনা, খাদ্য সংকট, আবাসস্থলে মানববসতি, সড়ক নির্মাণসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে বন্য হাতি চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে।
আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. নিয়াজ আহমদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হাতির সর্বশেষ অবস্থা জানতে বন বিভাগের সহায়তায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনাঞ্চলের ১০টি পথে জিপিএস কার্যক্রম চালানো হয়। এর মধ্যে মাটিরাঙা, মহালছড়ি ও লক্ষ্মীছড়ির বনাঞ্চলে হাতির বিচরণ লক্ষ করা যায়নি।' হাতির অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে নতুন করে চুনতি অভয়ারণ্য এলাকায় জিপিএস কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তিনি। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত দুই বছরে পাঁচটি হাতি
মারা পড়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার বাঁশখালীতে একটি স্ত্রী হাতি হত্যা করা হয়। গত ২৩ জুন সাতকানিয়ার সোনাকানিয়ায় বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যায় একটি হাতি। ২০০৯ সালে পাহাড়ি ঢলে হাঙ্গরখাল দিয়ে একটি হাতির মরদেহ ভেসে যেতে দেখা যায়। ২০০৮ সালে সাতকানিয়ায় পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে মারা যায় একটি হাতিশাবক। এর আগে গুলি করে একটি হাতি হত্যা করা হয়। আবার হাতির আক্রমণে গত তিন বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে অন্তত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ৯ ডিসেম্বর রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস গ্রামে হাতির আক্রমণে এক শিশুর মৃত্যু এবং ১০ জন আহত হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, হাতির চলাচলের পথ নির্দেশ করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বনাঞ্চলে নির্দেশক টাঙানো হয়েছে। চকরিয়া-লামা সড়কের পাশে হাতির প্রতীক সংবলিত এই নির্দেশক টাঙিয়েছে আইইউসিএনের বাংলাদেশ কার্যালয়। সড়কের ডান পাশেই টিলায় গাছের ওপর একটি মাচা। হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে গাছের ডালে মানুষের বসতির ব্যবস্থা এটি।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে হাতি চলাচলের তিনটি অঞ্চল হচ্ছে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ। বর্তমানে এই অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশই মানুষের দখলে চলে গেছে। একসময় চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে হাতির অবাধ বিচরণ থাকলেও এখন চিরহরিৎ বনেই সাধারণত হাতির বিচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, চুনতি অভয়ারণ্য, বাঁশখালী এবং কঙ্বাজারের টেকনাফ, রাঙামাটির রাজস্থলী ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্র।
বন সংরক্ষক (বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেল) তপন কুমার দে বলেন, 'জনবসতি ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে হাতির অভয়াশ্রম দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। হাতির খাদ্যের অভাবও দেখা দিয়েছে। তাই সামপ্রতিক সময়ে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্বের ঘটনা বেড়েছে। অর্থাৎ হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাচ্ছে। আবার মানুষের আক্রমণে হাতি মারা পড়ছে।'
সর্বশেষ ২০০৪ সালে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও আইইউসিএন পরিচালিত এক শুমারিতে দেখা যায়, দেশের ১১টি বন বিভাগে ২৫০ থেকে ৩৫০টি হাতি আছে। এ ছাড়া আরো ৮০ থেকে ১০০টি হাতি মিয়ানমারের আরাকান, ভারতের আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে। চিড়িয়াখানা ও বিভিন্ন সার্কাস মিলিয়ে বন্দি হাতির সংখ্যা ৯৪ থেকে ১০০টি।
হাতি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের নির্বাহী চেয়ারম্যান অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, হাতি সংরক্ষণে বনাঞ্চল রক্ষা, হাতির খাদ্য উপযোগী গাছ লাগানো, বন্য প্রাণী আইন মেনে চলা ও স্থানীয় জনগণকে হাতির আক্রমণ মোকাবিলায় সচেতন করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
Source: Dailykalerkantho

বিপদাপন্ন বাদামি ঘুরাল

বিপদাপন্ন বাদামি ঘুরাল

খসরু চৌধুরী | তারিখ: ২৭-০৯-২০১০

ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বিপদাপন্ন প্রাণী বাদামি ঘুরাল
প্রকৃত বন্য ছাগল বা মেষ—যেমন আইবেক্স, থর, ভারাল, শাপু, মারখর, মার্কোপোলোর ভেড়া ইত্যাদি পার্বত্য প্রাণীগুলোর অস্তিত্বের কোনো রেকর্ড বাংলাদেশ সীমানায় পাওয়া যায়নি। কিন্তু উপমহাদেশের তিনটি ছাগ-এন্টিলোপের দুটি—সারাও এবং ঘুরাল সম্ভবত বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সারাওয়ের অস্তিত্বের প্রমাণ চুনতি অভয়ারণ্যে এবং মিরসরাইয়ের করেরহাটের বনে পেয়েছি। বান্দরবানের সাজেক উপত্যকা ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ে প্রাণীটি আছে বলে শুনেছি।
ঘুরালের কথা খুব একটা শোনা যায় না। তবে মিয়ানমারের চিন্দুইন পাহাড়শ্রেণী ও আরাকান ইয়োমার যে অংশ বাংলাদেশে পড়েছে, সেখানে ঘুরালের অস্তিত্ব আছে বলে জানা গেছে। অবিভক্ত বাংলায় তিস্তা নদীর পার্বত্য চলার পথে একসময় প্রচুর ঘুরাল ছিল।
ঘুরালকে ছাগ-এন্টিলোপ বলা হয়। কারণ, এদের গড়ন ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য কিছুটা ছাগলের মতো, কিছুটা এন্টিলোপের মতো।
ঘুরাল (Nemorhacdus goral) মধ্যম আকারের প্রাণী। কাঁধের উচ্চতা ২৬ থেকে ২৮ ইঞ্চি, ওজন ২৭ কেজির মতো হয়। মাথা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত লম্বায় ১২৫ সেন্টিমিটার। লেজ ১০ সেন্টিমিটার, শিং ২০ সেন্টিমিটার।
ঘুরালের দুটি উপপ্রজাতি আছে। পশ্চিম হিমালয়ে পাওয়া যায় ছাইরঙা ঘুরাল (N.g.goral) আর পূর্ব হিমালয়, মিয়ানমার, বাংলাদেশে পাওয়া যায় বাদামি ঘুরাল (N.g.hodgsoni) ।
বাদামি ঘুরালের লোমের রং সোনালি-বাদামি, কোথাও কোথাও কালো ছোপ আছে। ঘাড় থেকে মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে কালো দাগ চলে গেছে লেজের ওপরিভাগ পর্যন্ত। হালকা কালো দাগ দেখা যায় ঊরুদেশে। গলার কাছটা ময়লাটে সাদা। ঘুরালের লোম খসখসে, কিছুটা অবিন্যস্ত। এদের শিং পেছনের দিকে বাঁকানো, বেশির ভাগ অংশ খাঁজকাটা। মেয়ে-পুরুষ উভয় ঘুরালেরই শিং গজায়। বাচ্চাদের রং অনেকটা লালচে ধাঁচের। এদের সামনের পায়ের খুরের ওপরে তরল গন্ধ নিঃসরণী ছিদ্র আছে। এই গন্ধ দিয়ে তারা নিজেদের এলাকা চিহ্নিত করে থাকে। এদের নাক-মুখের গড়ন থ্যাবড়ানো। এরা সাধারণত পাহাড়ের তিন হাজার ফিটের নিচে নামে না। এমনিতে একাকী প্রাণী হলেও চার থেকে আটটি প্রাণীর দলও কাছাকাছি থাকে।
ঘুরাল পাহাড়িপথে চলাফেরা করা প্রাণীদের মধ্যে অত্যন্ত পারদর্শী হিসেবে পরিচিত। পর্বতের খাড়া শিলাময় ধাপের ঘাসের জঙ্গল, ঝোপঝাড়ে এরা চরে বেড়ায়। সকাল, সন্ধ্যায় এরা বেশি কর্মতৎপর। তবে মেঘলা দিনে সারা দিনই এরা খাবারে ব্যস্ত থাকে। এরা লাফাতে, দৌড়াতে পারে অত্যন্ত দ্রুততায়। ভয় পেলে এদের বিপদজ্ঞাপক ডাক শুনতে অনেকটা মানুষের হাঁচির শব্দের মতো লাগে। বাংলাদেশে ঘুরাল অত্যন্ত বিপদাপন্ন প্রাণী।
Source:

Prothom Alo